কাথাল : দ্য কোর (২০২৩) চলচ্চিত্রটি সামাজিক রূপান্তরের গুরুত্বপূর্ণ এক সময়কালকে বর্ণনা করে, যা আলোকপাত করে পরিবর্তনশীল আইনি নিসর্গের মধ্যে ব্যক্তিগত পরিচয় পাড়ি দেওয়ার জটিলতার ওপর। এখানে সময় ও স্থানিক রাজনীতি খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কাথালকে ভারতীয় কুইয়ার ((QUEER)) চলচ্চিত্রের এক ধাপ উত্তরণ বলা যেতে পারে। তা ডিসকার্সিভ নির্মাণ-বিনির্মাণের চেষ্টা, এক কনটেক্স থেকে অন্য কনটেক্সে উত্তরণের গল্প। সংস্কারের এই অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়েই মূল গল্পটা প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে পেরেছে। সমকামিতার প্রতি ভারতীয় আইনের ক্রমবর্ধমান সহনশীল মনোভাবের পরিপ্রেক্ষিতে চলচ্চিত্রটি নির্মিত; যেখানে চিত্রায়ণ হয়েছে এমন একটি সময়, যার কিছু আগে তাকালেই দেখা যায় ৩৭৭ ধারায়১ যেকোনো সমকামি ব্যক্তির যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারতো। সেই ভয়াবহ অতীত পেরিয়ে আজকের ভারতের রূপান্তরের পটভূমিতে সেটা করা হয়েছে, যখন সমকামিতা জয়যুক্ত হয়েছে তার বৈধকরণের লড়াইয়ে। চলচ্চিত্রটি সামাজিক নিয়ম এবং ব্যক্তিগত সত্যতায় আড়াআড়িভাবে আটকা পড়া ব্যক্তিদের প্রতিক্রিয়া এবং ব্যক্তিগত সংগ্রামের বাস্তবতা ও আবেগকে অন্বেষণ করেছে চমৎকারভাবে।
নির্মাতা জিও বেবি’র কাথাল : দ্য কোর, অভিনয়শিল্পী মামুত্তি ও জ্যোতিকা অভিনীত, সমকামিতা এবং এর আইনি গ্রহণযোগ্যতা অর্জন ও কিছু অমীমাংসিত সম্পর্ক নিয়ে একটি চিন্তা-উদ্দীপক চলচ্চিত্র। গির্জায় চলচ্চিত্রের প্রারম্ভিক দৃশ্যটিতে কেন্দ্রীয় চরিত্রগুলোকে একসঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়, যেখানে ওমনা, ম্যাথিউ, ওমনার শ্বশুর এবং অন্যান্য বেশ কয়েকজনের দেখা মেলে। প্রোটাগনিস্ট পুরুষ চরিত্র ম্যাথিউ গির্জা থেকে বেরিয়ে যান একটি সালিশে, যেখানে ম্যাথিউর ব্যক্তিত্বের স্তরগুলো প্রকাশ পায়। ম্যাথিউকে সেখানে এক প্রেমিক যুগলের মধ্যে শ্রেণিগত পার্থক্য থেকে উদ্ভূত একটি পারিবারিক বিবাদে মধ্যস্থতা করতে দেখা যায়; প্রেমিকার বাবার প্রাথমিক অভিযোগ সত্ত্বেও, ম্যাথিউ সহানুভূতির সঙ্গে পরিস্থিতি সামলে নেন। এবং প্রেমিক যুগলের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা ও উভয়ের সম্মতির নিশ্চয়তা পেয়ে কলহের সমাধান করেন। এটা বৈষম্যের বিরুদ্ধে সামাজিক নিয়ম এবং সেখানে ম্যাথিউর নীতিগত দৃঢ় অবস্থান চিত্রায়ণের মধ্য দিয়ে, তার প্রতি দর্শকের ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ পেতে শুরু করে।
একইসঙ্গে সেখানে সমাজের দীর্ঘস্থায়ী রক্ষণশীল মনোভাব প্রকাশ এবং ম্যাথিউয়ের উদার ও ন্যায়বিচারের অবস্থানকেও নিশ্চিত করে কাহিনি অগ্রসর হয়। ম্যাথিউকে ইতিবাচকতার আলোয় রেখে হঠাৎ তার স্ত্রীর বিবাহবিচ্ছেদের আপিলের প্রসঙ্গটি, ম্যাথিউ চরিত্রটিকে একটি “Gray Zone”-এ নিয়ে যায়।
দুই.
ম্যাথিউ ডেভাসি (মামুত্তি) ও ওমনা (জ্যোতিকা) ১৯ বছর বয়সি মেয়ে ফেমি’র বাবা-মা। ওমনা ও ম্যাথিউ দম্পতির মধ্যে কোনো শত্রুতা নেই। কিন্তু প্রায় দুই দশকের দাম্পত্য জীবন থেকে ওমনা এখন মুক্ত হতে চান। তিনি ভরণপোষণ চাইছেন না, শুধু বিবাহবিচ্ছেদ চান! এবং এই প্রক্রিয়ায় ম্যাথিউর যৌনতা তার বিবাহবিচ্ছেদ আপিলের একমাত্র কারণ। বিবাহবিচ্ছেদ আপিলের মাধ্যমেই ম্যাথিউর আজীবন গোপন করে আসা সমকামি পরিচয়টি আকস্মিকভাবে প্রকাশ হয়। ওমনার চরিত্রের দৃঢ়তা, কাহিনিতে নিম্নবিত্ত, উচ্চবিত্ত উভয় শ্রেণির উপস্থিতি ও ক্ষমতার ভিন্নতা লক্ষণীয়। চলচ্চিত্রটির মাধ্যমে দর্শকও ম্যাথিউ চরিত্রের সূক্ষ্মতাকে অন্বেষণ করে। তবে ওমনার অভিযোগ, তিনি একজন সমকামি স্বামীর সঙ্গে দীর্ঘ ২০ বছরের দাম্পত্য জীবন পার করেছেন এবং তাকে যৌনতা থেকে বঞ্চিত করে ম্যাথিউ নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছেন। এই শক্তিশালী অভিযোগটি সামনে আসার সঙ্গে সঙ্গে ম্যাথিউর রাজনৈতিক এলাকায় তার চরিত্রটি তীক্ষèভাবে মোড় নেয়।
কেননা আসন্ন নির্বাচনে জনপ্রিয়তার ভিত্তিতে ম্যাথিউ ডেভাসিকে প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছে দল। ঠিক যখন তিনি ভোটের রাজনীতিতে প্রবেশ করেন, সমান্তরালে তার যৌনজীবন নিয়ে আলোচনা ও গুঞ্জন শুরু হয়, যা তাকে ভোটের মাঠে নতুন ধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলে দেয়। ম্যাথিউ চরিত্রটি কোনো সরল চিত্রায়ণের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তিনি বহুমুখী ব্যক্তিত্ব নিয়ে দর্শকের সামনে আবির্ভূত হন, তার ক্রিয়াকলাপ সঠিক ও ভুলের মধ্যকার রেখাগুলোকে অস্পষ্ট করে।
তিন.
কাথাল-এর গল্পের যে নাটকীয়তা, সেখানে গুরুত্বের প্রধান জায়গাগুলো হলো, বিভিন্ন চরিত্র ও তাদের অ্যাকশনগুলোর মধ্যে একটা সম্পর্ক এবং তাদের মধ্যে যে শারীরিক দূরত্ব চরিত্রগুলোর মোটিফ যা দর্শক মনে উৎকণ্ঠা তৈরি করতে দারুণভাবে কাজ করে। চরিত্রের মধ্যকার গূঢ় অর্থ প্রকাশ করতে বিভিন্ন সময় ক্যামেরার কারসাজি প্রয়োজন হয়েছে, এই প্রয়োজনকে নির্মাতার নিজস্ব ধারা (style) বলে মেনে নেওয়া যেতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক বিচার বিশ্লেষণে দর্শককে নির্মাতা স্বাধীনতাও দিয়েছেন। বিচিত্র মানব চরিত্র তাদের মনোজগৎ বিচিত্র ধরনের সেই চরিত্রের প্রতি মুহূর্তের দ্বান্দ্বিক মানসিকতা, উৎকণ্ঠা, চরিত্রের বিন্যাস ও নাটকীয় মুহূর্ত তৈরি করতে সুচিন্তিত ও অর্থপূর্ণ ক্যামেরা কোণ অতীব সহায়ক ছিলো।
অন্যদিকে, সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসকে এখানে গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে। যেখানে দেখা যায়, ম্যাথিউর ‘কথিত’ প্রেমিক থানকান (সুধী কোঝিকোড়) তার প্রাক্তন গাড়িচালক ও তার সন্তানকে সামাজিক কটাক্ষ বা সরাসরি সামাজিক আক্রমণের শিকার হতে হয়। কিন্তু উচ্চবিত্ত ম্যাথিউর অভিমুখীতা নিয়ে গুঞ্জন রটে গেলেও, তার ক্ষেত্রে সরাসরি কোনো আক্রমণ চোখে পড়ে না। এটা বুঝতে কষ্ট হয় না যে, সামাজিক নানা ঘাত-প্রতিঘাতের কারণে প্রত্যেক বিত্তবান শ্রেণির মধ্যে থাকা প্রান্তিকের বৈভব ও ক্ষমতাকে ব্যবহার করে তারা সমাজে টিকে থাকার তাগিদে আত্মপরিচয়কে ‘সুরক্ষিত সিন্দুকে’ (comfortable closet) লুকিয়ে রাখে।
চার.
কাথাল : দ্য কোর নিয়ে বিশদ আলোচনার আগে LGBTQIA+২ ব্যক্তিদের সামাজিক চাপগুলোকে প্রাসঙ্গিকভাবে উপস্থাপন করা গুরুত্বপূর্ণ এমনকি এমন দেশগুলোতেও যেখানে এই ধরনের পরিচয়গুলো আইনিভাবে স্বীকৃত। লেখক নিজে একজন QUEER advocate হিসেবে কাজ করার ফলে, ব্যক্তিগত পর্যায়ে নানা ধরনের প্রত্যাশা এবং দুঃশ্চিন্তার জটিল জালের সাক্ষী হয়েছেন। চলচ্চিত্রটি নিয়ে আলোচনার একপর্যায়ে লেখক তার কাছে মাস কয়েক আগে আসা একটি ফোনকলের কথা স্মরণ করতে চান। আমেরিকায় বসবাসরত একজন বাংলাদেশি প্রবাসী সমকামি পুরুষের সঙ্গে লেখকের সেই ফোনালাপ হয়। সেখানে ওই সমকামি প্রবাসী তার সমকামি যৌন পরিচয়চর্চা বজায় রেখেই নিশ্চিত ভবিষ্যতের আশায় বিষমকামী বিবাহ নামক সুরক্ষা বীমায় আগ্রহ দেখান। তার ওই ফোনালাপটি সামগ্রিকভাবে যৌন প্রান্তিক সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি বিস্তৃত সংগ্রামকে প্রতিফলিত করে। আমেরিকায় কুইয়ার অধিকার এখন যথেষ্ট সুরক্ষিত। তার পরেও সেই যুবক কেনো বিষমকামী বিবাহে আগ্রহী? কারণ, দক্ষিণ এশিয়ান হেটেরোনরমেটিভ ও মনোগামী বৈবাহিক সম্পর্ক পুরুষদের বৃদ্ধ বয়সে যে ‘অটুট পারিবারিক বন্ধনের’ নিশ্চিত আশ্বাস দেয়, যেটা থেকে এই সমকামি পুরুষটি নিজেকে বঞ্চিত করতে নারাজ। কাথাল-এর ম্যাথিউ চরিত্রে কিছুটা একই প্রকৃতির মানসিক দ্বন্দ্ব, চিন্তা ও মনের বিভিন্ন ভাবধারা লক্ষ করা যায়।
পাঁচ.
কাথাল-এর দৃশ্যবিবরণী ভালো করে লক্ষ করলে এক ধরনের দ্বন্দ্ব উপলব্ধ হয় প্রান্তিকের সঙ্গে আপাত গৌণের দ্বন্দ্ব। অতি নাটকীয়তা দোষে দুষ্ট ভারতীয় চলচ্চিত্রে প্রায়শই যে ধরনের শট্ দেখতে পাওয়া যায়, তা থেকে কাথাল : দ্য কোর অনেকটা ব্যতিক্রম। চলচ্চিত্রের সমকামি পুরুষ যেমন প্রান্তিক, তেমনই ‘সুরক্ষার বিয়ের’ জীবন্ত বলি নারীটিও সমাজের আপাত গৌণ। নির্মাতা এখানে দৃশ্যকল্পের অবয়বে কুইয়ার পলিটিক্সকে ধরতে চেয়েছেন ক্লিশে কুইয়ার ন্যারেটিভের একটা নরমেটিভ প্যাটার্ন থেকে বেরিয়ে এসে। সেই দিক বিবেচনায় নতুন বাস্তবতাকে উপস্থাপন, উপলব্ধি ও ব্যাখ্যার প্রশ্নে কাথাল চলচ্চিত্র হিসেবে খুবই কার্যকরী ভূমিকা রেখেছে, যা দর্শকের অনুধাবন ও উপলব্ধিকে প্রভাবিত করে ব্যাপক মাত্রায়। নতুন এ ন্যারেটিভটি প্রতিফলন ঘটিয়েছে সমাজের মনস্তত্ত্ব ও মূল্যবোধের।
কাথাল কুইয়ার সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পর্কের জটিলতাগুলোকেও বর্ণনা করে। সম্পর্কের মধ্যে যে প্লেটোনিক অংশীদারিত্ব থাকে, যা প্রায়শই উপেক্ষা করা হয়, তা এ চলচ্চিত্রে গভীর তাৎপর্যের সঙ্গে উপস্থাপন করা হয়েছে। ম্যাথিউ যখন তার প্লেটোনিক সঙ্গীকে হারানোর সম্ভাবনার মুখোমুখি হন, তখন এই সংযোগের গভীরতা এবং সামাজিক চাপের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী সাহচর্য খুঁজে পাওয়ার চ্যালেঞ্জগুলোকে দর্শক অনুভব করে। চলচ্চিত্রটি স্থিতিশীলতা এবং সাহচর্যের সন্ধানকারী ব্যক্তিদের মুখোমুখি হওয়া মর্মান্তিক বাস্তবতাকে আন্ডারস্কোর করে। আজীবন, আস্থাপূর্ণ সম্পর্কের আকাক্সক্ষার জন্য একজন সমকামির বিষমকামী বিবাহের সম্পর্ককে বেছে নেওয়ার চিত্রায়ণটি, বিশেষত রক্ষণশীল সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে মুখোমুখি হওয়া অনেকগুলো মর্মান্তিক দ্বিধাকে প্রতিফলিত করে।
চলচ্চিত্রে ‘সুরক্ষার বিয়ের’ ঘটনাটি যা দক্ষিণ এশিয়ায় ওপেন সিক্রেট তার চেহারা উন্মোচন করে; তবে খুব যত্ন, সম্মান ও সংবেদনশীলতার সঙ্গে। চলচ্চিত্রের দ্বিতীয়ার্ধে আদালত কক্ষে নাটকীয়তা মুখ্য হয়ে ওঠে এবং এখানেই চরিত্রগুলোর একে অন্যের যে সংগ্রাম তা সম্পর্কে দর্শককে ভাবায়।
কাথাল-এ সংলাপ খুবই কম, আদালত কক্ষে কিছু শব্দ বিনিময় ছাড়া। যা আমাদেরকে এই চরিত্রগুলোর সঙ্গে বোঝাপড়ার মধ্যে আটকে রাখে। কারণ তারা সবাই তাদের জীবন পরিবর্তন করার বিষয়ে একগুচ্ছ কথা নিয়ে হাজির হয়। যদিও চলচ্চিত্রের শেষে একটি প্রেমহীন বিবাহ ন্যায্য ফলাফল পায়; তবে ওই দাম্পত্য সম্পর্কটি এখনো একে অন্যের জন্য উদ্বেগ এবং যত্নে ভরা, যা যৌনতা/রোমান্টিসিজমের ঊর্ধ্বে ‘প্লেটোনিসিটি’কে প্রাধান্য দেয়। নির্মাতা আদালত কক্ষের নাটকীয় প্রান্তিকতার সারফেসকে উল্টে দিয়ে একটা নির্দিষ্ট প্যারামিটারে দেখাতে চেয়েছেন। যা হোমোনরমেটিভ অথরিটিকে চ্যালেঞ্জ করে। একটি মার্জিনাল অবস্থান থেকে, নিজের টিকে থাকার লড়াইয়ে জিততে, কীভাবে অন্যকে বছরের পর বছর মার্জিনালাইজড করে রাখা হয়, সেই ডিসকোর্স যখন সামনে আসে, তখন সাবজেক্টিভ হয় সেই সব ধ্যান-ধারণার সমষ্টি, যা এই ‘সুরক্ষার বিয়ে’ নামক সামাজিক ছাঁচটিকে টিকিয়ে রেখেছে।
সমাজের কর্তৃত্বের কেন্দ্রে যেহেতু পুরুষের অবস্থান, তাই একজন বিষমকামী নারীর অবস্থানও কম প্রান্তিক নয়। যে কারণে সমকামি সম্পর্কের বৈধতা যেমন প্রয়োজন, তেমনই সমাজের চাপ উপেক্ষা করতে অক্ষম হয়ে যে সমকামি পুরুষেরা বিষমকামী বিবাহের সম্পর্ককে ঢাল হিসেবে এতোদিন যাবৎ ব্যবহার করে এসেছে, তারা আসলে স্ত্রী তথা নারীকে পরিবার-সমাজ-ধর্ম-সংস্কৃতি নামের শেকলের আড়ালে বেঁধে রেখেছে। সেই বঞ্চিত নারী বিষয়ক ডিসকোর্সগুলো এতোদিন আড়ালেই পড়ে ছিলো।
তবে এটা স্বীকার করতেই হয়, দাম্পত্য প্লেটোনিসিটি একটা সময়ে গিয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবলম্বন হয়ে ওঠে। প্রেমবিষয়ক আলোচনায় প্রেমকে অনেক সময় লিমারেন্স৩-এর সম্পূরক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। লিমারেন্স আসলে একটা ফেইজ। ধারণা করা হয় মানুষের জীবনে সাধারণত লিমারেন্স সর্বোচ্চ চার বছর স্থায়ী হয়। তার মানে লিমারেন্স যেকোনো প্রেমের সম্পর্কে প্রথম চার বছর থাকে। এর পর যেকোনো সম্পর্ক যখন দাম্পত্যে পরিণত হয় কিংবা দীর্ঘদিনের একটা সম্পর্কে রূপ নেয়, তখন সেখানে দুটো জিনিস থাকে যৌনতা ও প্লেটোনিসিটি। রোমান্টিক রিলেশনশিপের রোমান্টিসিজমের সময়টা মাত্র চার বছর; বাকি সময়টা থাকে কেবল যৌনতা ও প্লেটোনিসিটি। ওমনা আর ম্যাথিউয়ের সম্পর্কে কেবল যৌনতার ঘাটতি লক্ষণীয়। কিন্তু পর্যাপ্ত পরিমাণে প্লেটোনিসিটি রয়েছে তাদের মধ্যে। এর সবচেয়ে বড়ো নিদর্শন চলচ্চিত্রের একেবারেই শেষ দৃশ্যে লক্ষ করা যায়। ওমনা যখন নতুন পার্টনারের সঙ্গে ডেটে কিংবা মিটিংয়ে যান, তখন তিনি তার নার্ভাসনেস-এর কারণে প্রাক্তন স্বামীকে নিয়ে যান সঙ্গ দিতে। নতুন সঙ্গী দেখা করতে আসলে ম্যাথিউ যখন ওই জায়গা থেকে ফিরতে থাকেন, তখন তার চোখে-মুখে এক ধরনের বিষণ্নতা ফুটে ওঠে। তার অভিনয়ের চমৎকার দক্ষতা চোখে পড়ে এই সময়ে। এই বিষণ্নতার পেছনের কারণ ম্যাথিউয়ের মনোগামীতা। তার এই মনোগামী সম্পর্কের প্রবণতা প্লেটোনিক সম্পর্কেও একইভাবে বহাল। তবে একটা কথা বলা প্রয়োজন, পলিগামী কিংবা মনোগামী কোনোটাই মানুষের সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশনের চয়েজ না যেভাবে অন্যান্য ওরিয়েন্টেশনের কোনোটাতে মানুষের নিজের কোনো হাত থাকে না। ম্যাথিউয়ের প্লেটোনিক সঙ্গী যখন অন্য কারো সঙ্গে নতুন সম্পর্কে আবদ্ধ হতে যান, তখন তার মধ্যে এই বিষণ্নতাটা ফুটে ওঠে।
আরেকটা বিষয় না বললেই নয়, ম্যাথিউয়ের প্রতি ওমনার যে প্লেটোনিক অন্তরঙ্গতা; এর কারণেই কিন্তু তিনি ২০ বছর এই দাম্পত্য জীবনটা সহ্য করেছেন। আইনিভাবে তার সঙ্গীকে যেনো কোনো ধরনের হেনস্তার শিকার না হতে হয়, জেলে যেতে না হয়, এইসব বিষয়গুলোও ওমনাকে বিবেচনায় নিতে দেখা যায়। ম্যাথিউয়ের সমকামি সম্পর্কের ব্যাপারটি ওমনা তখনই উল্লেখ করেন, যখন ভারতীয় আইনে তিনি আর দোষী সাব্যস্ত হবেন না। এই দীর্ঘ অপেক্ষা কোনো না কোনোভাবে ওমনার প্লেটোনিক সম্পর্কের নিদর্শন বলেই মনে হয়।
ছয়.
কাথাল-এর ন্যারেটিভে আদালত কক্ষের একটা বিষয় ভীষণভাবে চোখে পড়ে। ম্যাথিউ ও ওমনার সন্তান কীভাবে পৃথিবীর আলো দেখলো আদালতে যখন এই বিষয়টা নিয়ে আলোচনা হয়, তখন ওমনা বলেন, আমি মাঙ্গকার মানে চেয়ে নিয়েছি এই সন্তান। এই কথার সূত্র ধরে ম্যাথিউয়ের পক্ষের আইনজীবী বলেন, তার মানে আমার মক্কেলের কাছ থেকে জবরদস্তি করে নিয়েছেন এই সন্তান। এই কথাটা যখন তিনি (আইনজীবী) বলেন, ততোটা গুরুত্ব দিয়ে এটা বলেন না যে, এই জবরদস্তি করে নেওয়াটা আইনিভাবে নিষিদ্ধ, যেটা উনি (ওমনা) করেছেন; আমার মক্কেল চাইলেই আইনিভাবে আপনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেন। এ ধরনের আলোচনা এ চলচ্চিত্রে অনুপস্থিত। কারণ আন্তজার্তিক আদালতে স্পাউজাল রেপ-এর (বৈবাহিক ধর্ষণের) কোনো জেন্ডার নাই। কোনো নারী কিংবা পুরুষ, যে কেউ যদি শারীরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তার সঙ্গীর কাছ থেকে কোনো রকম জবরদস্তির শিকার হয়,তাহলে তিনি বৈবাহিক ধর্ষণের মামলা করার অধিকার রাখে। আদালতের কক্ষে যখন এই ধরনের কথাগুলো হয়, তখন ম্যাথিউয়ের পক্ষের আইনজীবী এই কথাটাকে জবরদস্তি বলার মধ্য দিয়ে সহজীকরণ করে ফেলেন। তিনি এটাকে ‘সামান্য’ ব্যাপার হিসেবে দেখেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ওমনার পক্ষের আইনজীবীর দেওয়া ব্যাখ্যাটাও প্রশ্নবিদ্ধ বলে মনে হয়।
কারণ মানুষের মধ্য সেক্সুয়াল ডিজায়ার৪-এর চারটা ধরন লক্ষ করা যায় সেক্স রিপার্লস, সেক্স অ্যাবার্স, সেক্স নিউট্রাল ও সেক্স পজেটিভ। যদি কেউ সমলিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট হয়, তাহলে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি তার আকর্ষণ, তার ডিজায়ার কীভাবে ডেভেলপ হচ্ছে, এটাও গুরুত্ব দিয়ে দেখার বিষয়। কেউ যদি সেক্স রিপার্লস কিংবা সেক্স অ্যাবার্স হয়, তাহলে সেক্সের জন্য তাকে জবরদস্তি করার কোনো অধিকার কারো নেই। এই জায়গায় থেকে চলচ্চিত্রে দেখা যায়, ওমনার পক্ষের আইনজীবী যেই ব্যাখ্যা হাজির করেন, সেটা খুবই দুর্বল। কারণ তিনি মনে করেন, এমন অনেক গে’রা আছে, যারা পারিপার্শ্বিক চাপে কিংবা হতাশায় থাকার কারণে বিপরীত লিঙ্গের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করে। ফলে এক্ষেত্রে বিষয়টি সাধারণীকরণ করা আসলে কতোটা যৌক্তিক? কারণ হোমোসেক্সুয়ালদের মধ্যেও বৈচিত্র্য লক্ষ করা যায়। চলচ্চিত্রে থানকানের ক্ষেত্রে যেটা দেখা যায়, তার দুই সন্তান আছে এবং তার স্ত্রীর সঙ্গে একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক লক্ষণীয়। এই জায়গা থেকে বলা যায়, তিনি হোমোসেক্সুয়াল (গে) হলেও বিপরীত লিঙ্গের প্রতি তিনি সেক্স পজেটিভ। তার মানে সমলিঙ্গের প্রতি কেউ আকৃষ্ট হলেও বিপরীত লিঙ্গের প্রতি তিনি পজিটিভ হতে পারে। অন্য গে’দের মানে যদি ম্যাথিউয়ের কথাই বলা যায় ২০ বছরের দাম্পত্য জীবনে তিনি মাত্র চার বার স্ত্রীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করেন বিষয়টি বিপরীত লিঙ্গের প্রতি তার সেক্স রিপার্লস কিংবা অ্যাবার্স হিসেবে ধরা যায়। এই ভিন্নতার বিষয়গুলো কাথাল : দ্য কোর-এ অনেকটাই অস্পষ্ট রয়ে গেছে।
সাত.
কাথাল : দ্য কোর-এর অন্যতম শক্তি হলো এর প্রোটাগনিস্ট ম্যাথিউ, তিনি সম্ভাব্য এম এল এ (MLA), যিনি সমকামি হতে পারেন বলে গুঞ্জন চলমান। তার এই পরিচয় কীভাবে রাজনীতি, ধর্ম ও সামাজিক প্রত্যাশার সঙ্গে সংঘর্ষ করে, তার সংক্ষিপ্ত চিত্রণ ক্ষমতার গতিশীলতা এবং সুবিধাবাদের একটি চিন্তা-উদ্দীপক অনুসন্ধানের প্রস্তাব দেয়। বামপন্থিদের একটা বড়ো অংশ আছে, যারা অনেক সময় ঢ়ংবঁফড় pseudo progressive। তবে দক্ষিণ ভারতীয় রাজনীতি, সেখানকার মানুষ, ধর্ম ও সামাজিকতা, সবকিছুকে একটু বুঝলেই কেনো সেখানকার মানুষ, একজন হোমোসেক্সুয়াল সম্ভাব্য এম এল এ হওয়ার পরেও ‘ততোটা’ প্রতিক্রিয়া দেখায় না, কেনো ওই পলিটিকাল পার্টি তার মনোনয়ন বাতিল করছে না, বরং উল্টো ম্যাথিউর কুইয়ার আইডেন্টিটিকে পুঁজি মনে করছে সেটা বুঝতে পারা যাবে।
কেন্দ্রীয় ম্যাথিউ চরিত্রকে ঘিরে একটি প্রশ্ন অনেকের মনে আসতে পারে, তিনি যে হোমোসেক্সুয়াল তা সমাজে কেনো এতোদিন সবাই জানেনি; কেনো বিবাহবিচ্ছেদের ঘোষণার পরেই হঠাৎ করে বিষয়টা জানাজানি হলো; এসব তো সমাজে খুব সহজেই জানাজানি হয়ে যায়। উত্তরটা এমন হতে পারে, চলচ্চিত্রের ন্যারেটিভে ম্যাথিউ চরিত্রকে যেভাবে নির্মাণ করা হয়েছে, তাতে সমাজে তার সেক্সুয়ালিটি নিয়ে জানাজানি হওয়ার সুযোগ কম। কেননা তাকে এখানে মনোগামী হিসেবেই দেখানো হয়েছে। যেহেতু তিনি অনেক বেশি মানুষকে রিচ-আউট করতে যান না, বহু বছর ধরে যার একজন পার্টনার আছে, তার হোমোসেক্সুয়ালিটি নিয়ে বাইরে জানাজানি হওয়ার সুযোগ কম ছিলো।
আট.
কাথাল-এর সম্পাদনার একটি মজার বিষয় হলো, কতোগুলো তুলনামূলক সংযোগহীন ঘটনা পর পর সাজিয়ে একটি গল্প তৈরি করা হয়েছে। ঘটনা কিংবা কাহিনি শুধু বুনিয়াদ হিসেবে কাজ করে যাকে ভিত্তি করে একটা ভাবধারা প্রকাশ করা যায় প্রতিটি পদক্ষেপ না দেখিয়ে-ও। এ চলচ্চিত্রে গোটা কয়েক কাজ বেছে নিয়ে এমনভাবে সাজানো হয়েছে, যাতে পর পর ঘটনাগুলোকে একটি গল্পের পূর্ণরূপ মনে হয়। পর পর ঘটনাগুলোর মধ্যে যোগসূত্র বজায় থাকে এবং সবটা মিলিয়ে একটি পূর্ণ ন্যারেটিভ ঘটেছে বলে মনে হয়। চলচ্চিত্রটি দর্শককে চিন্তা করতে প্ররোচিত করে; কেনো ম্যাথিউর যৌন পরিচয়ের কিছু দিক সমাজের বিভিন্ন দল আলিঙ্গন কিংবা শোষণ করে; সমাজের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা এবং শোষণের বৈপরীত্য এবং এর আর্থ-সামাজিক ও ধর্মীয় জটিলতাগুলোকে তুলে ধরে।
সম্পাদনার ক্ষেত্রে একটা চমক লক্ষ করা যায়, আদালত কক্ষে ওমনা কাঠগড়ায় ওঠার সময় স্বামীর কাছে ব্যাগটা রেখে যান। এর বিপরীতে একটু পরেই আদালত কক্ষের বাইরে, আদালত প্রাঙ্গণে এক দম্পতির দেখা মেলে। যারা বিবাহবিচ্ছেদের জন্য এসেছে, একই বেঞ্চে বিপরীত মুখ করে বসে আছে। এবং স্ত্রীর কোলে এক শিশু সন্তান। কিন্তু তাদের মধ্যে পারস্পরিক কোনো ধরনের যোগাযোগ কিংবা কথাবার্তা নেই। এই পরস্পর বিপরীত বিষয়কে সমান্তরালভাবে দেখার একটা সুযোগ নির্মাতা করে দিয়েছেন। বিবাহবিচ্ছেদের যে নানা ধরনের মাত্রা থাকতে পারে, সেটারই যেনো তিনি ইঙ্গিত করেন। মানে বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনাকে সাধারণীকরণ করার কোনো সুযোগ নেই। প্রতিটা বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রেই ভিন্নতা থাকতে পারে। কেবল পারস্পরিক দ্বন্দ্ব থেকেই যে মানুষ বিবাহবিচ্ছেদ বেছে নেয়, এই ব্যাপারটা সবসময় ঠিক নাও হতে পারে। অসম্ভব প্লেটোনিক সম্পর্কের পরও রোমান্টিক অ্যাট্রাকশন কিংবা সেক্সুয়াল অ্যাকট্রাকশনের অভাবের কারণেও মানুষ বিবাহবিচ্ছেদ করতে পারে। পারস্পরিক বোঝাপড়ার পরেও যে বিবাহবিচ্ছেদের মতো ঘটনা ঘটতে পারে, যেটা ম্যাথিউ ও ওমনার সম্পর্ক থেকে স্পষ্ট হয়। কিংবা খুব ‘বিশ্রী’ ধরনের সম্পর্ক তৈরি হওয়ার পরেও মানুষ বিচ্ছেদ চায়, যা আদালত প্রাঙ্গণের ওই দম্পতির কার্যকলাপে তুলে ধরা হয়। সম্পাদনার মাধ্যমে এই বিষয়গুলো চমকপ্রদভাবে হাজির করা হয়। যার মধ্য দিয়ে দর্শক নিজেদেরকে নতুন করে প্রশ্ন করার, ভিন্নভাবে ঘটনাগুলোকে ভাবার সুযোগ পায়।
নয়.
কাথাল ভারতীয় কুইয়ার চলচ্চিত্রের ল্যান্ডস্কেপের মধ্যে তাৎপর্য বহন করে, যা শুধু প্রেম, ট্র্যাজেডি বা আইনি লড়াইয়ের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে একটি সতেজ প্রস্থানের প্রস্তাব দেয়। কুইয়ার অভিজ্ঞতার কম আলোচিত দিকগুলো এবং সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার প্রভাবগুলোকে সম্বোধনের মাধ্যমে চলচ্চিত্রটি LGBTQ+ অধিকার এবং প্রতিনিধিত্বের আশপাশের বক্তব্যকে সমৃদ্ধ করে।
চলচ্চিত্রের শৈল্পিক যোগ্যতার বাইরে কাথাল সামাজিক পরিবর্তনের জন্য একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে কাজ করে; ধারণাগুলো গঠনে এবং সংলাপকে উৎসাহিত করার ক্ষেত্রে মিডিয়ার তাৎক্ষণিক এবং প্রভাবশালী ভূমিকাকেও হাইলাইট করে। চলচ্চিত্রে নির্মাতার যে অনবদ্য শৈলী দেখতে পাওয়া যায়, তা হলো; রহস্য না রেখে সোজাসুজি গল্প বলা, দৃশ্যকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিভক্ত করার সঠিক চলচ্চিত্রিক সময় ও ঘটনার নাটকীয় গুণ ও তার যুক্তিকে বিশেষভাবে প্রাধান্য দেওয়া। অলক্ষিত স্মুথ ম্যাচ কাটিং, এবং পরিশেষে ঘটনার ভারসাম্য ও যুক্তি দেখে দর্শক নির্মাতার বক্তব্যকে গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। কণ্ঠস্বর ও আখ্যানকে প্রায়শই প্রান্তিক বা উপেক্ষা করে চলচ্চিত্রটি কুইয়ার অভিজ্ঞতা এবং সমতা ও গ্রহণযোগ্যতার জন্য চলমান সংগ্রামের বিস্তৃতি বোঝার জন্য অবদান রাখে।
তবে কাথাল একজন ম্যাথিউর দৃষ্টিকোণ থেকে সবকিছু দেখতে এবং শুনতে পায়, যখন তার কথিত প্রেমিক থানকান একজন নীরব দর্শকে পরিণত হয়; তার মুখের অগণিত আবেগ তার মনের মধ্যে কী হয় বা কোন ধরনের সমীকরণ কাজ করে তার একমাত্র সূত্র। চিত্রনাট্যকারের পক্ষ থেকে এই নীরবতাগুলো, চিত্রগ্রাহকের ডেপথ ইন ফিল্ডের মাধ্যমে চরিত্রের মনের ভাব ফুটে ওঠে। চরিত্র দুটির দ্বান্দ্বিকতা, চিন্তার ভেতর দারুণ বৈপরীত্য যেমন পানশালায় থানকানের ছেলের সামাজিক হেনস্তায় বিধ্বস্ত হয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে কান্না এই দৃশ্যগুলো চমৎকারভাবে সামাজিক চাপ, বাবার সমকামি পরিচয় উন্মোচিত হওয়ার ফলে সন্তানের আবেগীয় আচরণগত বিষয়গুলোকে নিপুণভাবে উপস্থাপন করে। আরেকটি বিষয় খুবই চমৎকারভাবে লক্ষণীয় যে, একদিকে সমকামি বাবা থানকানের নীরবতা, অন্যদিকে সমকামি ছেলেকে নিয়ে ম্যাথিউর বাবার নীরবতা দুটি অ্যাকশন একইসঙ্গে দেখানো হয়েছে যা দর্শক মনকে ভাবাতে দারুণ অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে।
দশ.
কাথাল-এর একেবারে শেষ পর্যায়ে ম্যাথিউ ও তার বাবার কথোপকথন খুব চমৎকারভাবে রিভার্স অ্যাঙ্গেল শটের ব্যবহারে তুলে ধরা হয়। লম্বা বারান্দার কোণে, ক্যামেরার ঠিক কাছাকাছি, বাবা ও ছেলের মুখোমুখি অবস্থান। কথোপকথনের একপর্যায়ে ম্যাথিউর বাবা নিজ অবস্থান পরিবর্তন করে ছেলের পাশে গিয়ে বসেন। এই শটে ক্যামেরা দুজনের খুব কাছে চলে আসে। ক্লোজআপ শটের উপযুক্ত ব্যবহার শুধু দুই চরিত্রের মুখের ভাষা কিংবা ভাবনাই ফুটিয়ে তোলে না, সেইসঙ্গে মনের না বলা কথা, দ্বন্দ্ব-যন্ত্রণাও সার্থকভাবে ফুটিয়ে তোলেন চিত্রগ্রাহক। এরপরেই ক্যামেরাকে ঘুরিয়ে ঘরের দরজা থেকে দূরে দেখানো হয় ম্যাথিউর স্ত্রীকে, গোটা ঘরের মধ্যে তিনি একা!
চলচ্চিত্রে এ জাতীয় শটের বদৌলতে সম্পূর্ণ বিপরীত দুটো অনুভূতি, আলাদা দুটো ঘটনা ও ভাবের উপস্থিতি একইসঙ্গে দেখতে পাওয়া যায়। দুটো ভাবকে একসঙ্গে অনুভব করা, দুটো ঘটনাকে তুলনা করে চরিত্রগুলোর মানসিক ভাবের বিশ্লেষণ করা এবং দুটো ঘটনার মধ্যে কী সম্পর্ক তা বোঝানোর জন্য, এটা একটি সার্থক শট্, তা বলা যেতেই পারে। যা দুটো বিপরীত ঘটনার সমাবেশ, নাটকীয়তায় গুরুত্বপূর্ণ, এবং মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বে সমৃদ্ধ।
এগারো.
বৃটিশ কলোনিয়ালে ৩৭৭ ধারাটি ছিলো গোটা অবিভক্ত ভারতবর্ষের আইনে। যে আইনের কালো ছায়া আজও বাংলাদেশ ও পাকিস্তান বয়ে বেড়াচ্ছে। তবে ভারত থেকে তা নিজস্ব কাঁটাতারের মধ্যে মুক্ত হয়ে গেছে। যে অগ্রগামীতাকে উদযাপনে মেতে উঠেছে ভারতীয় সেলুলয়েড। তবে গতানুগতিক প্রসঙ্গগুলোকে ডিঙিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু সবচেয়ে অবহেলিত প্রসঙ্গকে কেন্দ্রবিন্দুতে আনতে সার্থক নির্মাতা জিও বেবির কাথাল : দ্য কোর। তিনি সম্পর্কগুলোকে অঙ্ক কষে দেখিয়েছেন, এর বাইরের অবয়বকেও দেখিয়েছেন, আবার প্রতিটা চরিত্রের মনের বহুমূখী অনুভুতিকেও ছুঁয়েছেন। পাশাপাশি চরিত্রগুলোতে দাপুটে অভিনয়শিল্পীরা দর্শককে বিশ্বাস করতে বাধ্য করেছে, সবই যদি অঙ্ক হয়, তাহলে আবেগটা কোথায়?
প্রথম প্রকাশ : ম্যাজিক লন্ঠন
টীকা
১. ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে আগে ভারতীয় দণ্ডবিধি ৩৭৭ ধারায় সমকামিতা অপরাধ বলে গণ্য হতো।
এই দণ্ডবিধি রদ করার মধ্য দিয়ে দুই প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ বা নারী সম্মতির ভিত্তিতে যৌন সম্পর্ক স্থাপনে আর কোনো বাধা থাকে না।
১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে বৃটিশ-ভারত সরকার এই ধারাটি প্রবর্তন করেছিলো।
২. LGBTQIA+ হলো Lesbian, Gay, Bisexual, Transgender, Queer, Intersex Ges Asexual|। এছাড়া (+) দিয়ে সাধারণত যে ধরনের লৈঙ্গিক পরিচয়কে শনাক্ত করা যায় না, সেগুলোকে বোঝানো হয়।
৩. লিমারেন্স : এই শব্দটি ১৯৭০-এর দশকে ডা. ডরোথি টেনোভ প্রথম ব্যবহার করেন। এই লিমারেন্সকে তিনি ব্যাখ্যা করেন অনেকটা প্রেমে পাগল ((Feeling Madly in love) হিসেবে।
বিস্তারিত দেখতে পারেন এই লিঙ্কে : https://marriagehelper.com/difference-between-love-limerence-lmc/; retrieved on: 22.05.2024