বিশ্বব্যাপী অযৌনচিত্ত এখনও সবচেয়ে কম আলোচিত প্রান্তিক প্রবণতাগুলির মধ্যে একটি, বিশেষ করে এমন মনোসামাজিক বৈশ্বিক সংস্কৃতিগুলিতে যেখানে যৌন সম্পর্ক, বিবাহ এবং প্রজননকে “বাধ্যতামূলক জীবনচর্চার” পর্যায় হিসাবে দেখা হয়। যদিও অনেকে অযৌনচিত্তকে কেবল “যৌন আকর্ষণের অনুপস্থিতি” হিসাবে দেখেন, বাস্তবতা অনেক বেশি জটিল – এবং এই অভিমুখীতার মানুষদের জীবনে ইউনিক মানসিক, সামাজিক এবং স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত চ্যালেঞ্জে পরিপূর্ণ। শিক্ষা, আলোচনা এবং মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তার মাধ্যমে, আমরা অযৌনচিত্ত ব্যক্তিদের জন্য গ্রহণযোগ্যতা, সুরক্ষা এবং মর্যাদার দিকে একটি পথ প্রশস্ত করতে শুরু করতে পারি।
১. অযৌনচিত্তএবং উচ্চ লিবিডো, একটি যন্ত্রণাদায়ক দ্বন্দ্ব: যৌন আকর্ষণ না থাকলেও কিছু ব্যক্তির (নারী, পুরুষ , ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ ও উভলিঙ্গ নির্বিশেষে) উচ্চ লিবিডো থাকতে পারে, এটিকে ব্যক্তি বিশেষে অনেক সারভাইবার যন্ত্রণাদায়ক সমন্বয় (অযৌনচিত্ত+উচ্চ লিবিডো) অনুভব করেন, যার ফলে মানসিক বিভ্রান্তি, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে অসুবিধা হয় এবং সুস্থভাবে নিয়মিত জীবন যাপন ব্যাহত হতে দেখা দেয়।
- চিকিৎসকদের অজ্ঞতায় ভুল পথনির্দেশনা- আমাদের অভিজ্ঞতায় এমন সদস্যদের আমরা চিকিৎসকের স্মরনাপন্ন হতে দেখেছি। এছাড়াও প্রায়শই অভিমুীতা “সংশোধন” করার লক্ষ্যে ভ্রান্তিমূলক চিকিৎসার দিকে পরিচালিত করে তাদের/আমাদের পরিবার, যা প্রান্তিক অভিমুখীতার সংগ্রামটিকে আরও জটিল করে তোলে বাংলাদেশের কিছু চিকিৎসকদের অজ্ঞতা, বাংলাদেশের চিকিৎসা সম্প্রদায়ের মধ্যে অযৌনতাকে যৌনঅক্ষমতার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে প্রায়শই ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। অত্যাধিক লিবিডো বৃদ্ধিকারি ভুল ঔষধসেবনে প্রচন্ড শারিরীক ক্ষতিসহ এর ফলে সৃষ্ট মানসিক স্বাস্থ্যের লড়াই আরও তীব্র হয় এবং আত্মহত্যার চিন্তাভাবনার ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।
২. অযৌনচিত্ত কিশোরদের পুরুষত্ব প্রমাণের মনোসামাজিক চাপ– কিশোর-বয়সী অযৌন এবং অ-রমন্যাসী ছেলেরা প্রায়শই পুরুষত্বের গৎবাঁধা প্রত্যাশা মেনে চলার জন্য তীব্র সামাজিক ও মানসিক চাপের সম্মুখীন হয়, যৌন আকর্ষন ছাড়াই যৌন অভিজ্ঞতার উপর জোর দেয়। এই প্রত্যাশা পূরণ করতে ব্যর্থতার ফলে গ্লানী, কুৎসা, যৌন-লজ্জা, ধীক্কার পেতে দেখা যায় এবং ফলস্বরূপ উদ্বেগ এবং হতাশা তাদের গ্রাস করে।
৩. আত্ম–অস্বীকৃতি এবং প্রতিনিধিত্বের অভাব– যৌনশিক্ষা ও অযৌনচিত্ত জ্ঞানের অভাব এবং বিসমকামী সামাজিক বাক্সের বাহিরের জীবনধারাকে ধর্মীয়,পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির অভাব অনেক অযৌনচিত্ত ব্যক্তিকে সর্বদা আত্ম-অভিমুখীতার-অস্বীকৃতি অর্থাৎ আত্ম-চিত্ত-সন্দেহ বা নিজের সত্তা ও চিত্তকে অস্বিকৃতির দিকে ঠেলে দেয়, তাদের অভিমুখীতাকে মেনে নেয়ার পরিবর্তে কেবল ‘সাধুত্ব’ বা ‘ব্যাক্তিগত পছন্দ’ হিসাবে ভুল ব্যাখ্যা করে। কিন্তু ‘অভিমুখীতা’ ও ‘ব্যাক্তিগত পছন্দ’সমপূর্ণ ভিন্ন দুটো বিষয়। যা বিচ্ছিন্নভাবে নিয়মিত মানসিক সুস্থতার উপর উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাব ফেলে।
৪. রোমান্টিক অযৌনচিত্তে তথাকথিত প্রেমের বিকল্প সংঙ্গায় ব্যক্তির মানসিক সংগ্রাম– রোমান্টিক অযৌনচিত্ত ব্যক্তি, যারা যৌন আকর্ষণের অভিজ্ঞতা বা আকাঙ্ক্ষা ছাড়াই গভীর মানসিক এবং রোমান্টিক বন্ধন খোঁজেন – তারা প্রায়শই একটি অনন্য এবং গভীর মানসিক স্বাস্থ্যের বোঝার মুখোমুখি হন। সমাজের প্রভাবশালী আখ্যান প্রেমকে যৌন ঘনিষ্ঠতার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত করে, যার ফলে রোমান্টিক সংযোগের বিকল্প মডেলগুলি প্রচলিত সমাজ ব্যাবস্থায় অদৃশ্য, অবৈধ বা এমনকি সাধারনের বোধগম্য অসম্ভব বলে মনে হয়। ফলস্বরূপ, রোমান্টিক অযৌনচিত্ত ব্যক্তিরা প্রায়শই অভিজ্ঞতা লাভ করে – দীর্ঘস্থায়ী বিশৃঙ্খলা এবং ভুল বোঝাবুঝি, আত্ম পরিচয়ের দ্বন্দ্ব, অযোগ্যতা এবং আত্ম-সন্দেহের অনুভূতি, টানাপোড়েনপূর্ণ সম্পর্ক , সম্পর্ক শোষণের ঝুঁকি সহ বিবিধ বিষয়। প্রেম এবং যৌনতা সম্পর্কে সামাজিক নিয়মগুলিকে আবশ্যিক ও অভ্যন্তরীণ করে তোলার ফলে রোমান্টিক অযৌন ব্যক্তিরা “ভাঙা”, “অপরিপক্ক” বা “পর্যাপ্ত নয়” বোধ করতে পারে। এই বিস্তৃত অযোগ্যতার অনুভূতি আত্মসম্মান নষ্ট করতে পারে এবং উদ্বেগ এবং হতাশার জ্বালাতন করতে পারে
৫. জোরপূর্বক বিবাহের প্রচলন (বিশেষ করে নারীদের ক্ষেত্রে)– বিবাহের চাপ এমনকি পারিবারিক নিপীড়ন বাংলাদেশে নিয়মিত ঘটনা। এদেশে বিবাহ এমন একটি সামাজিক মুদ্রা, যেটি একটি বয়সের নারীর না থাকলে তিনি একজন ভিখারীর চাইতেও হতদরিদ্র হিসেবে বন্ধুবান্ধব, কর্মজীবনের সহকর্মী, সমাজ এমনকি পরিবারের কাছে পরিগণিত হন। আমাদের নারী সদস্যদের নিয়ে জরিপে দেখা গেছে, বিশেষ করে যাদের বয়স ২৪ থেকে ২৯ – তাদের বেশিরভাগেরই বিবাহে অনাগ্রহ এবং অস্বীকৃতি জানানোর কারণে মা বাবা কর্তৃক শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ শিকার হয়েছেন । এছাড়া ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল তো নৈমিত্তিকার ব্যপার। অনেক ব্যক্তি জোরপূর্বক বিবাহের ফলে দীর্ঘস্থায়ী হতাশা, অবিরাম ভয় এবং মানসিক সংগ্রামের সম্মুখীন হন, যার সাথে প্রায়শই মানসিক আঘাতের লক্ষণ এবং চলমান আত্মহত্যার ধারণা থাকে।
৬. অসম অভিমুখীতায় বিবাহ ও বিবাহ পরবর্তী চ্যালেঞ্জ- অযৌন এবং অপ্রেমী (অ-রমন্যাস) ব্যক্তিদের মধ্যে বিবাহের ক্ষেত্রে প্রায়শই প্রত্যাশার ভারসাম্যহীনতা জড়িত থাকে, যেখানে একজন সঙ্গী তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলতে পারে এমন ত্যাগ স্বীকার করতে চাপ অনুভব করতে পারে।
- বিশেষ করে, যদি একজন মহিলা (নববিবাহিত স্ত্রী ) অথবা একজন পুরুষ (নববিবাহিত স্বামী) আবিষ্কার করেন যে তার স্বামী বা স্ত্রী অযৌনচিত্ত, এই ধরনের সংবেদনশীল পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য প্রতিটি পক্ষের কী দায়িত্ব, অধিকার, এই সম্পর্কে পারিবারিক/সামাজিক/রাষ্ট্রীয় জ্ঞানশুণ্যতাই বহু অপ্রীতিকর ঘটনার মূল কারন।
৭. বৈবাহিক ধর্ষণ এবং মানসিক স্বাস্থ্য– বৈবাহিক ধর্ষণের শিকার ব্যক্তিরা ধর্ষণ ট্রমা সিনড্রোম, উদ্বেগ, হতাশা এবং গুরুতর ক্ষেত্রে আত্মহত্যার প্রবণতা সহ গভীর মানসিক যন্ত্রণার সম্মুখীন হন। বৈবাহিক ধর্ষণের শিকার ব্যক্তি নানা ধরনের মানসিক সমস্যায় ভুগলেও তারা চিকিৎসার জন্য আসেন না। এসব ভুক্তভোগীদের মধ্যে মানসিক চিকিৎসা নেওয়ার হার এক শতাংশের কম।
৮. মৌলিক অধিকারের পদ্ধতিগত অস্বীকৃতি– অবিবাহিত মহিলারা সহ, যারাই “বিসমকামী সামাজিক বাক্সের বাহিরে” বলে মনে করা হয়, তারা প্রায়শই বাসস্থানের মতো প্রাথমিক ও মৌলিক অধিকারের পদ্ধতিগত অস্বীকৃতির সম্মুখীন হয়, যেই একটি মৌলিক সমস্যা হাজারো সমস্যার কেন্দ্রবিন্দু, এমন ব্যক্তিগন প্রতিনিয়ত ধর্মীয়,পারিবাহিক,সামাজিক,প্রতিষ্ঠানিক, ও আইনি বৈষম্যের শিকার হতে হতে , মানসিক অসহায়ত্ব, বিষন্নতা এবং অনিরাপত্তার গভীর অনুভূতি পোষণ করে।
৯. সন্তান উৎপাদনের পারিবারিক ও সামাজিক চাপ– পৃথিবীর মাত্র ১%জনগোষ্ঠী অযৌনচিত্ত সম্প্রদায়ের, ফলে সঙ্গী খুজে পাওয়াই দুরহ। তারপরে এমনকি দুটি অযৌনচিত্ত ব্যক্তির মধ্যে পরিচয়-সম্পর্ক-বিবাহের পরেও কি তাদের সমাজ সুখী হতে দেয়? আবশ্যিক প্রজনন সম্পর্কিত সামাজিক প্রত্যাশার চাপ নিয়মিত বজায় থাকে, সন্তানহীন দাম্পত্য এদেশে কুৎসার বিষয় , ব্যক্তিগত যৌনজীবন নিয়ে সচরাচরই প্রশ্নবিদ্ধ হতে হয় অযৌনচিত্ত দম্পতিদের। সন্তাণহীনদের ‘অপয়া’ ‘বাজা’ সহ বিবিধ গালি শুনতে হয়। এছাড়াও উত্তরাধিকারহীনদের নানাভাবে ঠকাতে চেষ্টা করে পরিবারের লোকজন। এসব দম্পতিগন প্রতিনিয়ত পারিবাহিক,সামাজিক ও আইনি বৈষম্যের শিকার হতে হতে, মানসিক অসহায়ত্ব, বিষন্নতা এবং অনিরাপত্তার অনুভূতি বোধ করে।
১০. একাকি বার্ধক্য ও নিঃসঙ্গ মৃত্যুর আতঙ্ক– দৃশ্যমান আদর্শ অযৌনচিত্ত জীবনী জানার অভাব থেকে যৌবনে সঙ্গীহীন আনন্দের জীবন থাকলেও প্রায়শই বৃদ্ধ বয়সে ভবিষ্যতের অনিরাপত্তা আতঙ্ক , জীবন সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য চাপ, উদ্বেগ এবং ভীতি তৈরি করে। কোন যৌন আকর্ষণ নেই বা খুব সামান্য পরিমানে যৌন আকর্ষন অনুভব করেন এমন ব্যক্তিদের প্রতি – বিশেষ করে যারা অবিবাহিত থাকেন বা একা থাকেন – তাদের প্রতি অবিরাম সামাজিক বৈষম্য, গভীর মানসিক পীড়া এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতায় মৃত্যুর ব্যাপক আতঙ্কের কারণ হয়।
সমষ্টিগত সমর্থন, শিক্ষা এবং মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তাসহ উপরুক্ত সকল সমস্যা উত্তরনে অযৌনচিত্ত ব্যক্তিরা—বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো সংস্কৃতিতে—যৌন নারীরা যে মানসিক এবং সামাজিক চ্যালেঞ্জগুলির মুখোমুখি হন তা গভীর সমস্যাযক্ত কিন্তু অপ্রতিরোধ্য নয়। অ্যাডভোকেসি, শিক্ষা এবং মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তায় সুচিন্তিত, সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে, আমরা এমন একটি বিশ্ব তৈরি করতে পারি যেখানে অযৌন মানুষ মর্যাদা, নিরাপত্তা এবং আনন্দের সাথে বসবাস করতে পারবে।
আমাদের উদ্যোগ ও কর্ম পরিকল্পনা:
- স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের যৌন বৈচিত্র্য সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেয়া।
- যৌন শিক্ষার লক্ষ্যে কিছু অনলাইন কোর্স ডিজাইন করা এবং সেখানে অযৌনচিত্ত অন্তর্ভুক্ত করা।
- আইনগত এবং সামাজিকভাবে বিকল্প পারিবারিক মডেলকে উদাহরন হিসেবে তুলে ধরা।
- অযৌনচিত্ত হেট ক্রাইম সারভাইভারদের জন্য তৈরি ট্রমা-অনুসন্ধানমূলক থেরাপি প্রদান করা।
- জোরপূর্বক বিবাহ এবং বৈবাহিক ধর্ষণের বিরুদ্ধে সক্রিয়ভাবে প্রচারণা চালানো।
অযৌনচিত্ত অনুভুতি স্বাধাবিক, বাস্তব, বৈধ এবং অন্য যেকোনো প্রবণতার মতো একই অধিকার এবং সুরক্ষার যোগ্য। এখন সময় এসেছে বিশ্ব – এবং বিশেষ করে বাংলাদেশের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলির – এই সত্যটি প্রতিফলিত করতে শুরু করা।
Hashtag
#Mental_Health
#Conversion_therapy
#Support_LGBTQ+_Youth